← Back

সংবাদপত্রে ২০৯ কোটি টাকা বকেয়া বিলের বোঝা

KawsarAhmed Sagor
সংবাদপত্রে ২০৯ কোটি টাকা বকেয়া বিলের বোঝা
ছবিঃ মোট পাওনা (শীর্ষ ৫ পত্রিকা বনাম অন্যান্য পত্রিকা)
কখনও এত আর্থিক সংকটে পড়েনি সংবাদপত্র

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্রগুলো বর্তমানে ২০৯ কোটি টাকারও বেশি বকেয়া বিজ্ঞাপন বিলের কারণে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উভয়ের কাছেই এই বকেয়া বিলগুলো আটকে আছে। এর ফলে দেশজুড়ে সংবাদপত্রগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং সম্পাদকীয় স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

১৯টি শীর্ষ দৈনিকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলা পত্রিকাগুলোর এখনও প্রায় ১২২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে (প্রথম আলো এই তথ্য প্রকাশ করেনি)। অন্যদিকে ইংরেজি দৈনিকগুলোর প্রায় ৮৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা বকেয়া আছে।

 

স্বতন্ত্র পত্রিকাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক বকেয়া রয়েছে দ্য ডেইলি স্টারের, যার পরিমাণ ২৬ কোটি টাকা। এর ঠিক পরেই রয়েছে যুগান্তর, যার বকেয়া ২৫ কোটি টাকা। আর কালের কণ্ঠ ও ইত্তেফাক—উভয়েরই ১৮ কোটি টাকা করে বিজ্ঞাপন বিল বকেয়া রয়েছে।

 

অন্যান্য দৈনিকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রতিদিনের ১৭ কোটি টাকা, সমকালের ১২ কোটি, দেশ রূপান্তর ও দ্য অবজারভারের প্রতিটির ১১ কোটি, নিউ এজের ১০ কোটি, ঢাকা ট্রিবিউনের ৮ কোটি ৪০ লাখ, ডেইলি সান ও আমাদের সময় প্রতিটির ৮ কোটি, জনকণ্ঠ ও ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রতিটির ৭ কোটি এবং ইনকিলাবের ৬ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এভাবে বড় অঙ্কের পাওনা আটকে থাকায় প্রায় সব পত্রিকাই সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশে সংবাদপত্রের প্রধান আয়ের উৎস এখনও বিজ্ঞাপন। এর একটা বড় অংশ আসে সরকারি মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, টেলিযোগাযোগ কোম্পানি এবং রিয়েল এস্টেট খাত থেকে।

কিন্তু দীর্ঘসূত্রিতা ও জটিল প্রক্রিয়ার কারণে এই বিল পরিশোধে বিলম্ব হচ্ছে, যা সংবাদপত্রগুলোর নগদ অর্থপ্রবাহে ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করছে।

 

শিল্পসংশ্লিষ্টরা সতর্ক করেছেন, বিজ্ঞাপন বিলের দীর্ঘস্থায়ী বিলম্ব সংবাদপত্রগুলোকে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণে, কর্মীদের বেতন স্থগিত রাখতে এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদনে বিনিয়োগ কমাতে বাধ্য করছে।

মুদ্রণ, বিতরণ ও কর্মীদের বেতনসহ দৈনন্দিন পরিচালন ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে পড়ায় সংবাদপত্রের সামগ্রিক মান ও সম্পাদকীয় স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ছে।

যেহেতু বকেয়া বিজ্ঞাপন বিলের বোঝা ক্রমশ বাড়ছে, তাই সংশ্লিষ্টরা সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি বিজ্ঞাপনদাতাদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন; যাতে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং সম্পাদকীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়।

একজন শীর্ষ বাংলা দৈনিকের সম্পাদক শুক্রবার ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “বকেয়া বিজ্ঞাপন বিলের কারণে সংবাদপত্র সবসময় আর্থিক চাপের মধ্যে থাকে, যা তাদের সামগ্রিক কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে।”

2

পত্রিকাভিত্তিক বকেয়া বিজ্ঞাপন বিল

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি আরও বলেন, “সরকারকে বিজ্ঞাপন বিতরণের প্রক্রিয়া কঠোরভাবে তদারকি করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে প্রচারসংখ্যা কম বা কার্যত নেই এমন পত্রিকাগুলো বড় পাঠকসংখ্যার পত্রিকার তুলনায় অপ্রতিষ্ঠিতভাবে বেশি বিজ্ঞাপন না পায়।”

সম্পাদক বলেন, “কোন পত্রিকা সরকারি বিজ্ঞাপন পাবে এবং কোনটি পাবে না তা নির্ধারণ করা বড় চ্যালেঞ্জ।”

ঢাকা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপ করেন ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক এবং মিডিয়া সংস্কার কমিশনের সদস্য শামসুল হক জাহিদ। তিনি বলেন, “আমরা আমাদের মিডিয়া কমিশনের প্রতিবেদনে এই সমস্যা সমাধানের জন্য সুপারিশ করেছি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দুই তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে আলাপের সময় একাধিকবার বিষয়টি উত্থাপন করেছি।”

সম্পাদক পরিষদের সদস্যও জাহিদ। তিনি আরও বলেন, “সংবাদপত্রগুলো আগে কখনও এত ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়েনি। বর্তমানে অধিকাংশ পত্রিকা আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। কারণ সরকারি বিজ্ঞাপন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে, পাশাপাশি বেসরকারি বিজ্ঞাপনও কমেছে।”

প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে মিডিয়া সংস্কার কমিশন আরও জানিয়েছে, বিজ্ঞাপন বিলের হার দীর্ঘ ১০ বছর ধরে কম রয়েছে এবং এটি কখনও পুনঃনির্ধারণ বা পুনর্বিবেচনা করা হয়নি।

প্রতিবেদনে আরও সুপারিশ করা হয়েছে যে, বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকের বিজ্ঞাপন হার আলাদাভাবে পুনর্বিবেচনা করা হোক। কারণ ভিন্ন ভাষার পত্রিকাগুলোর প্রচারসংখ্যা তুলনাযোগ্য নয়। সংবাদপত্র বাজারে পাঠকদের প্রাকৃতিক প্রবণতা স্থানীয় ভাষার দৈনিকের প্রতি বেশি হওয়ায় এ ধরনের পুনর্বিবেচনা জরুরি।

বকেয়ার মূল কারণ

শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রধানত সরকারি সংস্থাগুলোই বকেয়া বিজ্ঞাপন বিলের জন্য দায়ী। তাদের ধীরগতির পরিশোধ প্রক্রিয়ার কারণে এই বিল মেটাতে বছরের পর বছর সময় লাগে।

সংবাদপত্রে সরকারি বিজ্ঞাপন সরবরাহের কেন্দ্রীয় সংস্থা ফিল্ম ও প্রকাশনা অধিদফতর (ডিএফপি) বর্তমানে প্রায় ৩৬ কোটি টাকার বিল বকেয়া রেখেছে। এর বেশিরভাগই ২০১১ থেকে ২০২২ সালের অতিরিক্ত বা সংযোজিত বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “ডিএফপির বকেয়া বিল ৭০ কোটি টাকারও বেশি ছিল। সম্প্রতি ২০২৫ সালের জুনে তারা সংবাদপত্রের বকেয়া বিজ্ঞাপন বিলের প্রায় অর্ধেক পরিশোধ করেছে।”

একটি দৈনিক পত্রিকার প্রধান অর্থ কর্মকর্তা বলেন, “সমস্যা হচ্ছে, ডিএফপি এবং কয়েকটি সংস্থা ছাড়া বকেয়া সরকারি বিজ্ঞাপন বিলের কোনও কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার নেই। উপজেলা থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি সরকারি অফিস বিজ্ঞাপনের ওয়ার্ক অর্ডার ইস্যু করে। সেই অফিস ছাড়া আর কেউ জানে না কত বকেয়া আছে এবং মূল মন্ত্রণালয়ে কোনও রেকর্ড রাখা হয় না। বার্ষিক বাজেট প্রকাশের সময় কিছু বকেয়া পরিশোধ হয়। কিন্তু নতুন বকেয়া আবার জমতে থাকে। বাংলাদেশে সরকারি বিজ্ঞাপন পরিশোধের এটাই প্রচলিত ব্যবস্থা।”

একটি দৈনিক পত্রিকার সিনিয়র মার্কেটিং ম্যানেজার বলেন, “ভুয়া প্রচার সংখ্যার কারণে অনেক সময় তাদের সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য তালিকাভুক্ত অনেক পত্রিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়, যদিও সেই অনেক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয় না।”

তিনি আরও বলেন, “নিয়মিত প্রচারসংখ্যা নাই এবং শুধুমাত্র নমুনা সংখ্যা প্রকাশ করা তালিকাভুক্ত পত্রিকাও নিয়মিত পাঠকসম্পন্ন মূলধারার পত্রিকার প্রায় সমান সুবিধা পায়। এটি আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক গোলাম রহমান ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “বাংলাদেশের অধিকাংশ পত্রিকা সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল। কারণ বেসরকারি খাতের বিজ্ঞাপন যথেষ্ট নয়।”

তিনি ডিএফপি’র মিডিয়া তালিকার একটি বড় সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করেন। বলেন, “অনেক তালিকাভুক্ত পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয় না। তবুও মূলধারার দৈনিকগুলোকে তাদের সঙ্গে সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য প্রতিযোগিতা করতে হয়।”

তিনি আরও বলেন, “বর্তমান ব্যবস্থায় এটি সমাধান করা সহজ নয়। তাই প্রায় সব পত্রিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারকে প্রকৃত প্রচার সংখ্যার ভিত্তিতে বিজ্ঞাপন বরাদ্দ দেওয়া উচিত।”

গোলাম রহমান একসময় একটি মূলধারার বাংলা দৈনিকের সম্পাদকও ছিলেন। তিনি আরও বলেন, “বকেয়া বিজ্ঞাপন বিলের কারণে সংবাদপত্রের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছে এবং কিছু পত্রিকা আর সঠিকভাবে প্রকাশিত হতে পারছে না।”

তিনি সরকারের কাছে সুপারিশ করেছেন, এই শিল্পে দীর্ঘদিনের প্রয়োজনীয় স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সংবাদপত্রের ধরন, প্রচার সংখ্যা এবং মান অনুযায়ী বিজ্ঞাপন পরিশোধ নিয়মিতকরণ করা হোক।

নামাজের সময়

--:--:--
  • ফজর --:--
  • যোহর --:--
  • আসর --:--
  • মাগরিব --:--
  • এশা --:--
লোড হচ্ছে...

শহর নির্বাচন করুন

আরও পড়ুন

পদ্মায় মিথেন গ্যাসের সন্ধান
রাজশাহীর পদ্মায় মিথেন গ্যাসের সন্ধান: উদ্দীপনা, গবেষণা ও সম্ভাবনার নতুন অধ্যায়
Nov 10, 2025
ডিএনএ–গবেষণার জনক জেমস ওয়াটসন
ডিএনএ–গবেষণার জনক জেমস ওয়াটসন মারা গেছেন
Nov 08, 2025
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাকে
স্বাধীনতার মুখোশে গোলামী: খেলাফতের ডাক কেন জোরালো হচ্ছে?
Nov 08, 2025
indian army
বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের নতুন সেনা ঘাঁটি: আঞ্চলিক উত্তেজনা ও দ্বিপাক্ষিক টানাপোড়েন
Nov 07, 2025
স্বর্ণের দাম নিয়ে জেপি মর্গানের ভীতিকর ভবিষ্যদ্বাণী, ২০২৬-এ গড় দামে রেকর্ড আশঙ্কা
Nov 07, 2025
রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে গ্যাসের সন্ধান, বাপেক্সের তদন্ত শুরু
রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে গ্যাসের সন্ধান, বাপেক্সের তদন্ত শুরু
Nov 01, 2025
উইকিপিডিয়ার বিকল্প হিসেবে ‘গ্রোকিপিডিয়া’ চালু করলেন ইলন মাস্ক
Oct 29, 2025
গাজা যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি: আইডিএফ প্রধান আইয়াল জামির
Oct 29, 2025
গাজায় ‘শক্তিশালী হামলা’ চালাতে নেতানিয়াহুর নির্দেশ
Oct 29, 2025
রেলওয়ে প্রকল্পের লোহা চুরির মহোৎসব
Oct 26, 2025