বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে আলোচিত এক বক্তব্যে ইসলামী চিন্তাবিদ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক সম্প্রতি ড. জাকির নায়েক ইস্যু থেকে শুরু করে খেলাফত প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত এক বিস্তৃত আলোচনার অবতারণা করেন। তার বক্তব্য শুধু একটি ধর্মীয় মতামত নয়, বরং এটি একটি দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, যা মুসলমান সমাজের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও নেতৃত্বের সংকট নিয়ে গভীর প্রশ্ন তোলে।
ড. জাকির নায়েক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন
বক্তব্যের শুরুতে তিনি বলেন—“বাংলাদেশ কি স্বাধীন দেশ, না গোলাম দেশ?”
তার যুক্তি, যখন ভারতের সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ ড. জাকির নায়েকের আগমন বাতিল করে, তখন স্পষ্ট হয় যে রাষ্ট্রটি নিজের নীতিগত স্বাধীনতা হারিয়েছে। এ থেকেই তিনি প্রশ্ন তোলেন: প্রকৃত স্বাধীনতা কি শুধু ভৌগোলিক, না কি আদর্শিক ও নৈতিক স্বাধীনতাও দরকার?
তিনি বলেন, “যে রাষ্ট্র অন্য দেশের ইশারায় নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে, সে রাষ্ট্র স্বাধীন নয়।”
ইসলামী রাষ্ট্র ও খেলাফতের অপরিহার্যতা
বক্তা ব্যাখ্যা করেন যে ইসলাম কেবল ব্যক্তিজীবনের ধর্ম নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা—“Complete Code of Life।”
তিনি বলেন, “ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া ইসলামী জীবন পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সালাত, যাকাত, ন্যায়বিচার—সবকিছুই তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন রাষ্ট্রব্যবস্থা ইসলাম দ্বারা পরিচালিত হবে।”
তিনি ঐতিহাসিকভাবে উল্লেখ করেন যে আল্লাহ চারজন নবীকে রাষ্ট্রক্ষমতা দিয়েছিলেন—দাউদ (আ.), সুলাইমান (আ.), ইউসুফ (আ.) ও মুহাম্মদ (স.)। এর মাধ্যমে ইসলাম রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে বলে তিনি মত দেন।
ইউরোপের মধ্যযুগ, সেকুলারিজমের উত্থান ও মুসলিম বিশ্বের অবস্থান
বক্তার মতে, ইউরোপের “অন্ধকার যুগ” মূলত খ্রিস্টান চার্চের নিপীড়নের সময়কাল। কিন্তু তখন মুসলিম বিশ্ব ছিল সভ্যতা, শিক্ষা ও বিজ্ঞানের সোনালী যুগে।
তিনি বলেন, “যখন লন্ডনে রাস্তা পরিষ্কার করার জায়গা ছিল না, তখন স্পেনের কডোভা শহরে রাস্তায় বাতি জ্বলতো।”
ইউরোপ চার্চের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক করে। এখান থেকেই আসে সেকুলারিজম, যা ধীরে ধীরে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও লিবারালিজমে পরিণত হয়। বক্তার মতে, এই স্বাধীনতা মানুষকে নৈতিক পতনের দিকে নিয়ে যায়। এরপর সমাজতন্ত্রের উত্থান হয়, কিন্তু সেটিও ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত মানবসভ্যতা গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মিশ্র পথে এসেছে, যা প্রকৃত ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম নয়।
ইসলামের বিকল্পহীনতা
বক্তা বলেন, “মানুষ যত মতবাদ খুঁজেছে—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ—কোনোটাই মানুষকে ন্যায় ও শান্তি দিতে পারেনি। একমাত্র ইসলামই দিতে পারে।”
ইসলামী অর্থনীতি, খেলাফত ভিত্তিক রাজনীতি এবং সামাজিক ভারসাম্যই প্রকৃত মানবমুক্তির পথ বলে তিনি দাবি করেন।
ইউরোপীয় উপনিবেশ ও মুসলমানদের পতন
বক্তার মতে, মুসলমানদের পতনের মূল কারণ ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান—সব দেশের মানচিত্র ইউরোপ আঁকেছে। কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, রোহিঙ্গা—সব সমস্যার গোড়া ইউরোপের সৃষ্ট সীমারেখা।”
২০০ বছরের ইউরোপীয় উপনিবেশ মুসলিম সমাজের আত্মমর্যাদা, রাজনৈতিক কাঠামো ও নেতৃত্ব নষ্ট করেছে। মুসলমানরা এখনো সেই উপনিবেশিক কাঠামোর ভেতরে বন্দি।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সমালোচনা
বাংলাদেশের সংবিধানকে তিনি “ব্রিটিশ কাঠামোর কপি” বলে উল্লেখ করেন।
তার দাবি—“১৯৭১ সালে স্বাধীনতা এলেও কাঠামো বদলায়নি। তাই প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি।”
তিনি বলেন, “আগের কাঠামো রেখে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়; আগের কাঠামোকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেই নতুন ইসলামী খেলাফতের উত্থান হবে।”
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বাস্তব শর্ত
বক্তা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চারটি শর্ত উল্লেখ করেন, যা ইবনে খালদুন-এর তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে:
আসাবিয়াহ (Ideological Unity) – নিজ আদর্শের প্রতি দৃঢ়তা।
ন্যায় প্রতিষ্ঠা – রাষ্ট্র টিকে থাকে ন্যায়ের উপর।
ভোগবিলাস থেকে বিরত থাকা।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান।
তিনি বলেন, “যে রাষ্ট্রে অন্যায় ও দুর্নীতি আছে, সে রাষ্ট্র টিকবে না। ইসলামী রাষ্ট্র মানে যেখানে প্রত্যেক মানুষ ন্যায় বুঝে পায়।”
ঈমান বিল গায়েব ও নেতৃত্বের পুনর্গঠন
বক্তার বক্তব্যে একটি মূল তত্ত্ব ছিল—ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, যতক্ষণ না জনগণের ঈমান শক্তিশালী হয়।
তিনি বলেন, “মানুষের ঈমান যদি ‘ইয়াকিনের লেভেলে’ না থাকে, তাহলে ক্ষমতা পেলেও ইসলাম চালানো সম্ভব নয়।”
তিনি আফগানিস্তানের উদাহরণ টেনে বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি টিকে গেছে কারণ তাদের ভোগবিলাসের চাহিদা নেই; ঈমানই তাদের মূল শক্তি।
নেতৃত্ব সংকট ও মুসলিম চরিত্রের অবক্ষয়
বক্তা বলেন, “মুসলমানরা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, কিন্তু আমানতদার নয়। সত্যবাদিতা হারিয়েছে। এই জন্য আল্লাহ তাদের নেতৃত্ব কেড়ে নিয়েছেন।”
তিনি আল্লামা ইকবালের উদ্ধৃতি টেনে বলেন:
“সাদাকাত, শুজাত ও আদালত—এই তিন গুণ ফিরে না এলে মুসলমান পৃথিবীর নেতৃত্ব ফিরে পাবে না।”
বাস্তব কর্মপরিকল্পনা: শিক্ষা, মিডিয়া ও অর্থনীতিতে শক্তি বৃদ্ধি
বক্তার মতে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে শক্তিশালী সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, “সারা বাংলাদেশের সব মসজিদ-মাদ্রাসা মিলে এক ব্রাকের সমান নয়। আমাদের ব্রাকের মতো অর্থনৈতিক শক্তি তৈরি করতে হবে।”
তিনি তিনটি অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেন:
শক্তিশালী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
ইসলামী মিডিয়ার বিকাশ।
সুদমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
দাওয়াত ও প্রজন্ম গঠনের আহ্বান
শেষে তিনি বলেন, “দাওয়াতি কাজ কখনো ছোট কাজ নয়। নূহ (আ.) ৯৫০ বছর দাওয়াতি কাজ করেছেন।”
তার মতে, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, ঈমান ও আসাবিয়ার উপর ভিত্তি করে নতুন প্রজন্ম তৈরি হলে, সেখান থেকেই ইসলামী বিপ্লব আসবে।
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাকের এই বক্তব্যে ধর্ম, ইতিহাস, রাজনীতি ও সমাজতত্ত্ব একত্রে মিশেছে। তার মূল বার্তা হলো—ইসলামী রাষ্ট্র কোনো আবেগের ফল নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া যা ঈমান, শিক্ষা, ন্যায়, নেতৃত্ব ও সামাজিক শক্তির সমন্বয়ে গঠিত।
তিনি উপসংহারে বলেন:
“যে প্রজন্ম সত্যবাদী, আমানতদার, ন্যায়পরায়ণ, আর ঈমানদার হবে—সেই প্রজন্ম থেকেই ইসলামী রাষ্ট্রের উত্থান হবে।”