দীর্ঘ দুই দশকের স্থবিরতা কাটিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে অনুষ্ঠিত ভোটে ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত “সম্মিলিত ছাত্র ঐক্যজোট” বিপুল বিজয় অর্জন করেছে। শুক্রবার ভোরে কাজী নজরুল অডিটোরিয়ামে ফলাফল ঘোষণার সময় দেখা যায়, শিবির-সমর্থিত প্যানেল ২৩টির মধ্যে ২০টি পদে জয় পেয়েছে। বাকি তিনটি পদে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেলের প্রার্থীরা।
নির্বাচন চলাকালে পুরো ক্যাম্পাস ছিল কঠোর নিরাপত্তার আওতায়। দিনব্যাপী ভোটে অংশ নেন প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল:
সহ-সভাপতি (ভিপি):
শিবির-সমর্থিত প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ ১২,৬৮৭ ভোট পেয়ে ভিপি পদে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী “ইউনাইটেড নিউ জেনারেশন” প্যানেলের শেখ নূর উদ্দিন (আবির) পেয়েছেন ৩,৩৯৭ ভোট।
সাধারণ সম্পাদক (জিএস):
একটি ব্যতিক্রমী ফলাফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আম্মার ১১,৪৯৭ ভোট পেয়ে সাধারণ সম্পাদক পদে জয়লাভ করেন। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন ফজলে রাব্বী প্যানেলের মো. ফাহিম রেজা, যিনি পেয়েছেন ৫,৭২৭ ভোট।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ:
সংগঠন সম্পাদক, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, প্রকাশনা সম্পাদক এবং বিতর্ক সম্পাদকসহ বেশিরভাগ নির্বাহী ও বিভাগীয় পদে বিজয়ী হয়েছেন শিবির-সমর্থিত প্রার্থীরা।
অন্যদিকে খেলাধুলা সম্পাদক পদে নরগিস আক্তার এবং বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক পদে তোফায়েল আহমেদ তোহা স্বতন্ত্রভাবে জয়লাভ করেন।
ভোটগ্রহণ শুরু হয় সকাল ৮টায় এবং চলে বিকেল পর্যন্ত। পুরো প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক আব্দুল মতিন সাংবাদিকদের বলেন,
“ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন পর তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক।”
ভোটে অংশগ্রহণের হার প্রায় ৭০ শতাংশেরও বেশি, যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনী ইতিহাসে বিরল ঘটনা বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) প্রায় দুই দশক ধরে নিষ্ক্রিয় ছিল। ২০০০ সালের পর থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক নির্বাচন হয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অবশেষে নির্বাচন আয়োজন করে।
ইসলামী ছাত্রশিবির, যা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠন, অতীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাবশালী ছিল। তবে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ে।
এই নির্বাচনে তাদের বিপুল জয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে—এটি কি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সাংগঠনিক পুনরুত্থানের সূচনা?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাকসু নির্বাচনের এই ফলাফল বাংলাদেশের ক্যাম্পাস রাজনীতির জন্য একটি নতুন অধ্যায় সূচিত করেছে।
একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন,
“দীর্ঘদিনের পর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা মতপ্রকাশ ও অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে—এটাই সবচেয়ে ইতিবাচক দিক। তবে এই ফলাফল ভবিষ্যতে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে নতুন ভারসাম্য ও চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই রাকসু নির্বাচন শুধু একটি ছাত্রসংসদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘটনা নয়—এটি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির গতিপথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। শিবির-সমর্থিত জোটের এই অভূতপূর্ব বিজয় হয়তো নতুন করে রাজনীতি, সংগঠন এবং মতাদর্শিক উপস্থিতির সমীকরণ বদলে দিতে পারে রাজশাহীর শিক্ষাঙ্গনে।