২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর রাত। বুয়েটের একটি আবাসিক হলের কক্ষে ঘটে যায় বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির এক অন্ধকার অধ্যায়—মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অভিযুক্তরা ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের একদল কর্মী। তাদের অভিযোগ, আবরার ‘ছাত্রশিবিরের’ সাথে জড়িত। কিন্তু তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণে স্পষ্ট হয়ে যায়, আবরারের একমাত্র অপরাধ ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলা এবং বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার পক্ষে অবস্থান নেওয়া।
ট্যাগিং রাজনীতির সূচনা: ২০০৯-এর পর থেকে এক ধারাবাহিকতা
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের শিক্ষাঙ্গনে এক ধরনের ‘ট্যাগিং রাজনীতি’ গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন প্রায়ই তাদের মতের বিরোধী ছাত্রদের উপর ‘শিবির’, ‘বিরোধী’, বা ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ ট্যাগ লাগিয়ে শারীরিক নির্যাতন, হুমকি, এমনকি হত্যা পর্যন্ত চালিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এমন ঘটনায় প্রায় ছয় হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন—যাদের অনেকেই নিখোঁজ বা পঙ্গু হয়ে গেছেন।
আবরারের অপরাধ: দেশপ্রেমের অন্য নাম
আবরার ফাহাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ বিদ্যুৎ ও পানি চুক্তি নিয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, এই চুক্তিগুলো বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বার্থের পরিপন্থী। তাঁর পোস্টে কোনো উসকানিমূলক বা সহিংস বার্তা ছিল না—বরং তা ছিল বিশ্লেষণাত্মক ও দেশপ্রেমমূলক। কিন্তু এ সমালোচনাই তাঁর জীবন কেড়ে নেয়।
বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্যাতন করে তাঁকে হত্যা করা হয়, এবং পরে লাশ ফেলে দেওয়া হয় সিঁড়ির পাশে। পুরো দেশ তখন ক্ষোভে ফেটে পড়ে, এবং “আবরার হত্যার বিচার চাই” স্লোগানে রাস্তায় নামে হাজারো মানুষ।
আধিপত্যবিরোধিতা থেকে ভয়: ছাত্র রাজনীতির বিকৃতি
বিশ্লেষকরা বলছেন, আবরার ফাহাদের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড নয়। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী’ মত প্রকাশের উপর ভয়ানক দমননীতির প্রতিফলন। যে কেউ ভারতীয় প্রভাব বা চুক্তির সমালোচনা করলেই “রাষ্ট্রবিরোধী” বা “চরমপন্থী” হিসেবে ট্যাগ করা হতো।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে এমন এক পরিবেশে, যেখানে ক্ষমতাসীন দল ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখাকে “রাষ্ট্রীয় নীতি” হিসেবে তুলে ধরে, এবং এর বিরুদ্ধে কথা বলা মানে সরকারবিরোধিতা। ফলে দেশপ্রেমিক অবস্থানই অপরাধে পরিণত হয়।
পরিবর্তনের আহ্বান
জুলাই ২০২৫-এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁরা আর কখনো এমন বর্বর রাজনীতি দেখতে চান না। আবরারের নাম এখন কেবল এক ছাত্র নয়, বরং স্বাধীন চিন্তা, সত্য বলা ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক।
আবরারের সহপাঠীদের একজন বলেন,
“আমরা কেবল ন্যায়ের জন্য লড়িনি, আমরা কথা বলার স্বাধীনতার জন্য লড়েছি—যা আবরারের রক্তে লেখা আছে।”
আবরার ফাহাদ হত্যা ছিল কেবল এক তরুণের প্রাণনাশ নয়, বরং বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির বিবেকনাশের প্রতিচ্ছবি। এবং এর মূলে ছিল এক গভীর ভয়—ভারতীয় আধিপত্যবাদের সমালোচনা করলে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা পাওয়ার ভয়।