ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস গাজার দখল নেয় ২০০৭ সালে। কিন্তু এরপরও নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হাতছাড়া করেনি ইসরায়েল। গাজাকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে এর স্থল, জল ও আকাশপথে তৈরি করে প্রতিবন্ধকতা।
জাতিসংঘ বলছে, এই প্রতিবন্ধকতার কারণে গাজার বাসিন্দাদের কাজ কিংবা চিকিৎসার জন্যেও অন্য কোথাও যেতে ইসরায়েলি বাহিনীর অনুমতি নিতে হয়। এমনকি গাজার উপকূলে জেলেদেরও একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। ইসরায়েলের তৈরি করা এই প্রতিবন্ধকতা সবচেয়ে নির্মম পরিস্থিতি ধারণ করেছে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে। বিপদের সময়ও বৈশ্বিক ত্রাণ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ গাজাবাসী।
গাজার বাসিন্দাদের জন্য ত্রাণ নিয়ে যে নৌবহর যাত্রা করছে সেটির কর্মীরাও এই বলয়ের কাছে গিয়েই ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক ও হামলার শিকার হচ্ছেন। তবে বৃহস্পতিবার গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা কমিউনিটি ট্র্যাকার জানিয়েছে, মিকেনো নামে তাদের একটি নৌকা গাজার জলসীমায় প্রবেশ করেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় আরও কয়েকটি নৌকার অবস্থান জানা যায়নি। এই বহরের কোনো একটি নৌকা গাজা উপকূলে নোঙর করলে সেটি হবে ইতিহাস। যা গত ১৮ বছরে কেউ তৈরি করতে পারেনি।

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ট্র্যাকার অনুযায়ী বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় নৌযানগুলোর অবস্থান।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা কী
আরবি শব্দ সুমুদ অর্থ ধৈর্য্য, অটলতা ও সহনশীলতা। আর স্প্যানিশ ফ্লোটিলা শব্দের অর্থ ছোট ছোট জাহাজের বহর। মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে, ফিলিস্তিনিদের প্রেক্ষাপটে সুমুদ শব্দটি একেকভাবে ব্যবহার হয়। যেমন- ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধমূলক কাজকেও সুমুদ বলা হয়। আবার বিদেশে থাকা ফিলিস্তিনিদের কাছে সুমুদ মানে হলো- ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলোর পণ্য বর্জন করা।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ ও তাঁদের প্রতি আন্তর্জাতিকভাবে সংহতি জানাতেই সুমুদ শব্দটি বেছে নেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে অটল থাকাটাই তাদের কাছে একটি ‘সুমুদ’।
ওয়েবসাইটটিতে আরও জানানো হয়েছে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা হলো বিভিন্ন দেশের সংগঠক, চিকিৎসক, শিল্পী, ধর্মগুরু, আইনজীবী, নাবিকদের একটি জোট। এই জোটের সদস্যরা বিভিন্ন দেশ ও ধর্মের অনুসারী হলেও তাদের লক্ষ্য- গাজায় অবরোধ ও গণহত্যা বন্ধ করা। এর সদস্যরা স্বাধীন এবং কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার লক্ষ্য
এই নৌবহরে করে ফিলিস্তিনিদের জন্য ত্রাণ যেমন- খাদ্য ও ওষুধ সামগ্রী বহন করা হচ্ছে। আয়োজকরা বলছেন, এটি প্রতীকী সহায়তা। তবে তাদের মূল লক্ষ্য হলো ইসরায়েল গত ১৮ বছর ধরে গাজা উপত্যকায় যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছে সেটি ভেঙে ফেলা।

স্পেন থেকে যাত্রা শুরুর সময় নৌযানে অধিকারকর্মীরা। ছবি: আনাদোলু এজেন্সি
অধিকারকর্মীরা বলছেন, তাদের এই কাজের উদ্দেশ্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। প্রায় ২৩ মাস ধরে একটি ভূখণ্ডে হামলা ও হত্যাযজ্ঞের কারণে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। তবুও তাদের দিকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সরাসরি খাদ্য সহায়তা পাঠানোর কোনো জোরালো তৎপড়তা নেই। বিশ্বনেতাদের সেই ঘুম ভাঙানোর জন্যই তারা নিজেদের নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে সাগরে নেমেছেন।
যাত্রা শুরু হয় যখন
মূল নৌবহরের যাত্রা শুরু হয় গত ১ সেপ্টেম্বর স্পেনের বার্সেলোনা থেকে। ভূমধ্যসাগরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় এতে অন্যান্য দেশের কর্মীরাও যোগ দেন। ছোট ছোট নৌকায় থাকা কর্মীদের নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়ার জন্য সঙ্গে আছে কয়েকটি বড় জাহাজ আছে।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আছেন সুইডেনের জলবায়ু ও রাজনৈতিক অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, বার্সেলোনার সাবেক মেয়র, নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি ম্যান্ডলা ম্যান্ডেলা, বাংলাদেশের আলোকচিত্রী শহিদুল আলমসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অধিকারকর্মীরা।

সিসিলিতে একটি নৌযান ঘিরে মানুষের ভিড়। ফাইল ছবি: এএফপি
মূল নৌযান যাত্রা শুরুর পর গত ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর তিউনিশিয়ায় দুইবার এব গত সপ্তাহে গ্রিসে হামলার শিকার হয়। গতকাল বুধবার সকালে ফ্লোটিলার মূল বহর মিশরের উত্তরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ছিল। আয়োজকরা তখন বলেছিলেন, কোনো বাধা না এলে বৃহস্পতিবার সকালে তারা গাজা উপকূলে পৌঁছাবেন। কিন্তু বুধবার রাতেই ইসরায়েলি বাহিনী নৌযানগুলো ও এর কর্মীদের আটক করতে শুরু করে।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় প্রায় ৪৩টি নৌযান ছিল। এতে ছিলেন বিভিন্ন দেশের ৫০০ জন কর্মী। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী একটি বাদে সবগুলো নৌযানেই বাধা দিয়েছে। আটক করা হয়েছে অধিকারকর্মীদের। তাদের ইসরায়েলের বন্দরের দিকে নেওয়া হচ্ছে।
আগের চেষ্টা ও পরিণতি
গাজা অবরোধ ভাঙার চেষ্টা চলছে ২০১০ সাল থেকে। ওই বছর মাভি মারমারা নামে তুরস্কের একটি জাহাজ গাজা উপকূলের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। তবে পথে ইসরায়েলি সেনারা তা আটকে দেয়। মারমারার কর্মীদের সঙ্গে সেনাদের সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হন। এ নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দুই বছর পর ইসরায়েল তাদের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। তুরস্কে এখনো ওই হামলায় জড়িতদের বিচার চলছে।

বুধবার গ্রেটা থুনবার্গ ও তাঁর সঙ্গীদের আটক করে ইসরায়েলি সেনারা। ছবি: সংগৃহীত
২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একাধিক ফ্লোটিলা ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করে। তবে প্রতিবারই ইসরায়েলি সেনারা তা আটকে দেয়। এসব নৌযানের কর্মীদেরও তখন আটক করা হয়েছিল।
চলতি বছরের জুনে খাবার, ওষুধ ও শিশু খাদ্য নিয়ে ম্যাডলিন নামের জাহাজ সিসিলির কাতানিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে। সুইডেনের অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ তখনও এই জাহাজে ছিলেন। ৯ জুন আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলি নৌবাহিনী জাহাজটি আটকায়। ভেতরে থাকা ১২ জনকে আটক করে। পরে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
এবার কি অবরোধ ভাঙবে
আগেরগুলোর তুলনায় এবারের নৌবহরকে বলা হচ্ছিল সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টা। এর কর্মীরা বলেছেন, বিপুল সংখ্যক নৌকা থাকার কারণে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের জন্য সবগুলো আটকানো কঠিন হবে।
তবে সুমুদ আয়োজকরা বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে জানিয়েছেন, যে নৌকাটি গাজা উপকূলের কাছে গিয়েছিল সেটির সঙ্গে তারা যোগাযোগ হারিয়েছেন।